মণিপুরে ড্রোন হামলা: সংঘাতের নতুন মাত্রা, ছড়িয়েছে উত্তেজনা



উত্তম সিনহা, 11.09.2024

ভূমিকা
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্য মণিপুর দীর্ঘদিন ধরে জাতিগত ও রাজনৈতিক সংঘর্ষের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। মেইতেই এবং কুকি সম্প্রদায়ের মধ্যে চলমান সহিংসতা সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ড্রোনের ব্যবহারকে কেন্দ্র করে এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। স্থানীয় জাতিগত সংঘর্ষ এখন প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত যুদ্ধে পরিণত হয়েছে, যেখানে ড্রোন হামলা অভূতপূর্ব সহিংসতা বৃদ্ধি করছে।

মণিপুরে অস্ত্রবাহী ড্রোনের ব্যবহার সংঘাতকে আরও জটিল করেছে, যা নিরাপত্তা বাহিনী, সাধারণ জনগণ এবং রাজনৈতিক নেতাদের উদ্বেগ বাড়িয়েছে। এই প্রযুক্তির ব্যবহার শুধু তাত্ক্ষণিক প্রাণহানি ও ধ্বংসের জন্য নয়, ভবিষ্যতের সংঘর্ষে এর প্রভাব সম্পর্কে আশঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই প্রতিবেদনে, আমরা এই সংঘাতের পটভূমি, ড্রোন হামলার তাৎপর্য এবং এর বিস্তৃত প্রভাবগুলি বিশ্লেষণ করব।

সংঘাতের পটভূমি
মণিপুরে মেইতেই এবং কুকি-জো সম্প্রদায়ের মধ্যে চলমান সংঘর্ষের গভীর শিকড় রয়েছে। মেইতেইরা মূলত মণিপুরের সমতল অঞ্চলে বসবাস করে এবং কুকি-জো ও নাগা উপজাতিরা পাহাড়ি অঞ্চলে বাস করে। জমির অধিকার, রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব, এবং সাংস্কৃতিক পরিচয় নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে উত্তেজনা ছিল। বর্তমান সহিংসতা মে ২০২৩ সালে মেইতেইদের তফসিলি উপজাতি মর্যাদা দাবির বিরুদ্ধে উপজাতি সম্প্রদায়ের বিক্ষোভ মিছিল থেকে শুরু হয়েছিল।

২০২৩ সালের এপ্রিল মাসে উচ্চ আদালতের রায়ে মেইতেইদের তফসিলি উপজাতি হিসেবে অন্তর্ভুক্তির সুপারিশ করা হলে, পাহাড়ি উপজাতিদের মধ্যে অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ে। তাদের আশঙ্কা ছিল, এই রায় তাদের আরও প্রান্তিক অবস্থায় নিয়ে যাবে। ২০২৩ সালের মে মাসে শুরু হওয়া সহিংসতায় ২০০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয় এবং কয়েক হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়, যা মেইতেই এবং কুকি সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদকে আরও গভীর করে তোলে।

ড্রোন যুদ্ধের উত্থান
বিশ্বের বিভিন্ন সংঘাতময় এলাকায় ড্রোন প্রযুক্তির ব্যবহার হলেও, মণিপুরে প্রথমবারের মতো ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে এই প্রযুক্তি সহিংসতার অংশ হয়ে ওঠে। ১লা সেপ্টেম্বর, ইম্ফল পশ্চিমের কৌট্রুক গ্রামে একটি ড্রোন বোমা ফেললে দুইজন নিহত হয় এবং নয়জন আহত হয়। পরের দিন, সেঞ্জাম চিরাং এলাকায় আরেকটি ড্রোন হামলায় তিনজন আহত হয়।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই ড্রোনগুলো স্থানীয়ভাবে সংগৃহীত যন্ত্রাংশ দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল, যা এই প্রযুক্তির সহজলভ্যতা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি করেছে। নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন, ড্রোন পরিচালনার দক্ষতা পার্শ্ববর্তী দেশগুলির বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলির কাছ থেকে আসতে পারে।

সহিংসতার বৃদ্ধি
ড্রোন হামলার পর মণিপুরে সহিংসতার মাত্রা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ৬ই সেপ্টেম্বরের একটি রকেট হামলায় একজন নিহত এবং পাঁচজন আহত হয়েছে। এই ধরণের হামলা আরও উত্তেজনা তৈরি করেছে এবং উভয় সম্প্রদায় পরস্পরকে দোষারোপ করছে।

নিরাপত্তা বাহিনী এখন বিপর্যস্ত এলাকাগুলিতে অ্যান্টি-ড্রোন সিস্টেম মোতায়েন করছে এবং মণিপুর সরকার ড্রোন হামলার বিষয়ে তদন্ত শুরু করেছে। মুখ্যমন্ত্রী এন. বীরেন সিং এই হামলাকে সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ড হিসেবে নিন্দা করেছেন এবং রাজ্যে শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের ঘোষণা দিয়েছেন।

প্রশস্ত প্রভাব
মণিপুরে ড্রোন প্রযুক্তির ব্যবহার শুধু রাজ্যের জন্যই নয়, বরং বিস্তৃত অঞ্চলের জন্যও তাৎপর্যপূর্ণ। ড্রোন যুদ্ধের প্রসার ভারত এবং এর প্রতিবেশী অঞ্চলের অন্যান্য বিদ্রোহী এলাকায় সম্ভাব্য হুমকির সূচনা করেছে।

ড্রোনের ব্যবহার অসম যুদ্ধের নতুন ধাপের সূচনা করে, যেখানে স্বল্প ব্যয়ে প্রযুক্তি ব্যবহার করে বৃহত্তর ক্ষতি সাধন করা যায়। এতে নিরাপত্তা বাহিনীর জন্য চ্যালেঞ্জ বাড়ছে এবং ভবিষ্যতে আরও পরিশীলিত আক্রমণের সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে।

সমাপ্তি
মণিপুরে ড্রোন হামলার ঘটনাগুলি সংঘাতের নতুন রূপের প্রতিফলন ঘটায়। এই প্রযুক্তি সহিংসতাকে আরও জটিল করে তুলেছে যা উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার পথে বড় অন্তরায় হিসেবে দাঁড়িয়েছে।

Comments