মা'য়ের আরাধনায় মা'য়েরা #kamalpur #dhalai #news #crime #kalipuja #deepawali
উত্তম সিনহার রিপোর্ট
সাতাশ অক্টোবর রবিবার। ঊনকোটি জেলার কৈলাসহর থেকে ধলাই জেলার মনু ঘাট। তারপর প্রায় উনত্রিশ কিলোমিটার দীর্ঘ লংতরাই পাহাড়ের চড়াই উতরাই পেড়িয়ে আমবাসা বাজার। সেইখানে কর্ম সম্পাদন শেষে আমবাসা-কমলপুর পথ ধরে এগিয়ে যাওয়া। অত্যন্তই উবর খাবর রাস্তা। বাইকের গতিবেগ বড়জোড় বিশ থেকে পঁচিশ কিলোমিটার প্রতি ঘন্টা। শান্তির বাজার পেড়িয়ে কিছু এগিয়ে আসতেই সালেমা থানাধীন দক্ষিণ আভাঙ্গা। এই আভাঙ্গা শব্দটির সাথে বেশ পরিচিত রাজ্যের মানুষ। আভাঙ্গার সাথে হয়তবা অনেকেই প্লাস করে দিয়েছেন 'আভাগা' শব্দটি।
ঘটনা ৩১ মার্চ ১৯৯৮ সন। ঘড়িতে বড়জোড় ১১টা কি ১২টা। পরিস্কার আকাশ, সূর্য ঝকঝক করছিল সেদিন। রাজ্যে ক্ষমতায় ছিল বামফ্রন্ট সরকার। তৎকালীন সময়ে কমলপুর কেন্দ্রের বিজয়ী বাম বিধায়ক প্রয়াত বিমল সিংহ ছিলেন রাজ্যের স্বাস্থ্যমন্ত্রী। তিনি আগরতলার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন। তার কানে খবর পৌঁছায় যে উত্তর আভাঙ্গা স্থিত CRPF ক্যাম্পের পূর্ব পাশেই কলকল করে বয়ে চলা ধলাই নদীর চরে উগ্রবাদীরা তার সঙ্গে দেখা করতে চাইছে। কারণটা কি? কারণটা ছিল বিমল সিংহের কণিষ্ঠ ভ্রাতাকে উগ্রবাদীরা কমলপুর-কুমারঘাট সড়কের সাইকার পাহাড় থেকে অপহরণ করেছিল এবং তার মুক্তির ব্যাপারেই উগ্রবাদীরা সাক্ষাৎ করতে চাইছে বিমল সিংহের সাথে। কাল বিলম্ব না করে বিমল বাবু নিজ ছোট ভাই বিদ্যুৎ সিংহকে নিয়ে আভাঙ্গা স্থানে পৌঁছান। সঙ্গে কোন দেহরক্ষীকে নেননি। দুই ভাই মিলে ধলাই নদীর জলে নামতেই গর্জে উঠল AK-47 রাইফেল। দুই ভাইয়ের সমস্ত রক্ত ভেসে গেল সেদিন ধলাই নদীর জলে। পরে সেখান থেকে সোজা কমলপুর হাসপাতালে। কিন্ত সব শেষ। সেই থেকেই যেন 'আভাগা' শব্দটি যুক্ত হয়ে গেল 'আভাঙ্গা'-র সাথে।
আভাঙ্গা এলাকাটি দুই ভাগে বিভক্ত। উত্তর আভাঙ্গা ও দক্ষিণ আভাঙ্গা। আমবাসা থেকে কমলপুরের দিকে এগিয়ে গেলে প্রথমে দক্ষিণ আভাঙ্গা। দূর থেকেই নজরে পড়ল কয়েকজন মহিলা হাতে লম্বা লম্বা বই নিয়ে গাড়ি অটো বাইক টুকটুক সব থামাচ্ছেন। হাতের লম্বা বইগুলি বুঝিয়ে দিল যে শ্যামা পূজোর জন্য চাঁদা সংগ্রহ চলছে। একদম কাছে পৌঁছতেই মিষ্টি হাসিতে ডাক এল কানে-- দাদা, দাঁড়ান দাঁড়ান। ব্রেক কষতেই তিনজন এসে কাছে দাঁড়ালেন। মন মুগ্ধকর অমলীন হাসিতে এক দিদির সোজা কথা--মায়ের নামে যদি কিছু দেন। কত দেব? উত্তর ছিল-- যাই দেন খুশি মনে।
দেওয়া তো পরের কথা, প্রথমে তো আমাকে দিতে হবে, তারপর আমি দেব। ব্যাস শুরু করলাম রেকর্ডিং। তবে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরেছি, এখনও ঘুরছি। কখনও নজরে পড়েনি যে কোন প্রধান সড়কে ঘরের মা বোনেরা এভাবে দাঁড়িয়ে চাঁদা সংগ্রহ করছে। অনেকেই হাসি মুখে চাঁদা দিচ্ছেন, অনেকেই আবার ফাঁক বুঝে চম্পট দিচ্ছেন। অনেকের কথা হল-- পরে দিমু নে। অথচ ওই দিদিদের মুখে এক ফোঁটাও বিরক্তি নেই। গ্রামের সরল সিধে মিষ্টি হাসিতে সবই গ্রহণ করে চলেছেন।
কথার ফাঁকেই জানা গেল এই দিদির নাম সুপ্রীতি, একজন গৃহিনী। পিতৃবাড়ি খোয়াই জেলার বড় লুঙ্গা স্থানে স্কুলের পাশেই। বিয়ে হয়েছে এই দক্ষিণ আভাঙ্গাতে। বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী বাঙালি সহ মিশ্র বসতি রয়েছে এই এলাকায়। এখানে তারা শ্যামা পূজো করছেন বহু আগে থেকেই। সঠিক প্রমাণ না থাকলেও অন্ততঃ পঁচিশ বছর হবে আরাধনা চলছে। নেই কোন চাঁদাবাজি, নেই কোন নির্দিষ্ট বাজেট। সবাই মিলে যা অর্থদান করেন এবং চাঁদা স্বরূপ যা সংগ্রহ হয়, সেটাই তাদের বাজেট।
আমার সাথে কথা চলাকালীন সময়েই অনেক গাড়ি হুশ করে দৌঁড়ে গেছে সুযোগ বুঝে। অনেকেই তো আবার এখানে সেখানে চাঁদা দিতে দিতে বিরক্ত। আর দেরি না করে ফটাফট সেরে ফেললাম তাদের সাক্ষাৎকার পর্ব।
ফেরার পথে সুপ্রীতি দিদিকে জিজ্ঞেস করলাম-- আপনাদের এই মিষ্টি হাসির রহস্য যদি আমাকে বাতলে দেন। দিদি যেন হাসিতে ফেটে পড়লেন। হাত নাড়িয়ে বলে উঠলেন--এই রহস্য না হয় আগামী বছর জানিয়ে দেব।
তাই ভাবছি, আগামী বছর শ্যামা মায়ের আরাধনা পর্ব পর্যন্ত আমাকে বাঁচতেই হবে সুপ্রীতি দিদির ওই রহস্যটা জানার জন্যে।।
Comments
Post a Comment