"আপনাকে মনে রাখবে কৈলাসহর"
রিপোর্ট: উত্তম সিনহা
কয়েক দশকের উগ্রপন্থার আগুনে পুড়ে অবশেষে শান্তির পথে পা মাড়িয়েছিল সবুজ বনানী ত্রিপুরা রাজ্য। বাগমা, বড়মুড়া, আঠারোমুড়া, লংতরাই, ভাঙমুন, সাইকা পাহাড়গুলির সবুজ ঘন জঙ্গল বহু রক্ত দেখেছে, চাক্ষুস করেছে বহু লাশ। কোন এক বছর স্বাধীনতা দিবস পালনের দিন কাঞ্চনপুড় পাহাড়ে একটি টিআরটিসি বাস থামিয়ে স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র থেকে যাত্রীদেরকে লক্ষ্য করে বুলেট ছুঁড়ে হত্যা করা হয়েছিল প্রকাশ্য দিবালোকে। কিছুদিন পূর্বে মুখ্যমন্ত্রীর উপস্থিততিতে হীরাছড়ায় নিষিদ্ধ ঘোষিত একাধিক উগ্রবাদী সংগঠনের সদস্যরা আত্মসমর্পণ করে। সেই হীরাছড়াতেই একদা প্রায় কুড়ি জন টিএসআর জওয়ানের কনভয়ের উপর অতর্কিত হামলা চালিয়ে নির্মমভাবে হত্যা যজ্ঞ সংগঠিত করেছিল উগ্রপন্থীরা। লুন্ঠন করা হয় সরকারি আগ্নেয়াস্ত্র। টিএনভি, এটিটিএফ (টাইগার ফোর্স), এটিটিএফ (ট্রাইবেল ফোর্স), এনএলএফটি (বিশ্বমোহন), এনএলএফটি (নয়নবাসি), সেংক্রাক সহ আরো অগণিত নামধারী বহু উগ্রপন্থী দলের উত্থান পতন দেখেছেন রাজ্যবাসি। দেখেছেন ওই সব উগ্রবাদী দলের তপ্ত বুলেটে ঝাঁঝড়া হয়ে যাওয়া নিজের প্রাণের মানুষের লালচে-কালচে রক্তমাখা লাশ গুলি। চরম আকারে ছিল অপহরণ বাণিজ্য। ব্যবসায়ী পথচারী সরকারি কর্মচারী শিশু যুবক মেয়ে মা মহিলা, কেউই বাদ যায়নি তাদের বন্দুকের নলের মুখ থেকে। সরকারি কর্মচারীরা যারা দূর দূরান্তে পাহাড় পেড়িয়ে গিয়ে জনজাতি অধ্যুষিত এলাকায় ডিউটি করতে যেতেন, চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতেন। সকালের সূর্য দর্শন হলেও সন্ধ্যা বাতি দেখবেন কিনা জানতেন না। তাদেরকে গুণতে হত বেতনের একটা অংশ চাঁদা বাবদ। নতুবা ট্রিগারের এক চাপেই জীবন খতম।
ঘটেছে বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া সহ জ্যান্ত পুড়িয়ে মারার অসংখ্য ঘটনা। সেকেলের সর্ব বৃহৎ নর সংহারটি ছিল খোয়াই কল্যাণপুর বাজার কলোনীর জেনোসাইড। সেই রাতে অনেকেই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন বা তৈরি হচ্ছিলেন বিছানার জন্য। পুরো গ্রামটিকে একে ফরটি সেভেনের মুখে ঘেরাও করে প্রতিটি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়। আচমকার আগুনে বাঙালিরা যখন প্রাণ বাঁচাতে ঘর থেকে দৌঁড়ে বেড়িয়ে এলেন, চারিদিক অন্ধকারে যখন কিছুই দেখা যাচ্ছিল না, এসএলআর, একে ফরটি সেভেন, একে ফিফটি সিক্সের অবিরাম গুলিতে রক্তস্নাত বাঙালিরা একে একে লুটিয়ে পড়েছিল অন্ধকারের কোলে। কতজন শিশু কতজন মহিলা কতজন প্রাপ্ত অপ্রাপ্ত বয়স্করা নিহত হয়েছিলেন বা তারা সমুচিত ক্ষতিপূরণ পেলেন কি না, রাজ্যবাসি হয়তবা জানেনই না। অনুরুপভাবে অপর একটি ঘটনা ঘটেছিল যা পশ্চিম জেলার সিমনা যজ্ঞেশ্বর নগর কলোনীর নর সংহার বলে ইতিহাসের পাতায় রচিত থাকবে। প্রায় পঁচিশটি বাঙালি পরিবার ঘুমিয়েছিল সেই রাতে। অনেকে খাওয়া দাওয়া করছিলেন মেঝেতে বসে, অনেকের চোখ টিভির পর্দায়। বাংলাদেশ সীমান্তের একদম পাশেই অবস্থিত ওই এলাকার সেই প্রায় পঁচিশটি বাঙালি পরিবারকে ঘরের উপর পেট্রোল ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। ঘর থেকে বেড়িয়ে এলেই গুলিতে খতম। সেই রাতে এক পরিবারে পাঁচ সদস্য আগুনে জ্যান্ত পুড়ে মারা যান, অপর একটি বাড়িতে চারজন। দ্বিতীয় ঘরের গৃহকর্তা সেদিন আগরতলায় অবস্থান করায় প্রাণে বেঁচে যান। আগুনে পুড়ে অসংখ্য গবাদি পশুর মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। এই কলমচি পরদিন গিয়েছিল ঘটনাস্থলে। ছিল এক চরম করুণ চিত্র। অর্ধ পোড়া গবাদি পশু সহ মানব দেহের দুর্গন্ধে দম যেন বন্ধ হয়ে আসছিল। কোলের এক কন্যা শিশুকে হাতে ধরে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছিল আঁধারে। তার মা বাবা সেই ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হয়ে খুন হয়। ঘটনার পরদিন কড়া নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে গণ দাহ করা হয়েছিল ঠিক খোয়াই কল্যাণপুরের ঘটনার মতো। খোয়াইয়ে আজও প্রতি বছর ওই গণদাহ করা স্থানে নির্দিষ্ট দিনে সবাই হাজির হন অশ্রু নয়নে শ্রদ্ধা জানাতে। সেকেলের যৌবনকাল পেড়িয়ে আজ বৃদ্ধাবস্থায় পরিণত হওয়া অসংখ্য বাঙালিদের অন্তরে কিন্ত সেই রাতের ক্ষত আজও তরতাজা হয়ে আছে। সরস্বতী পূজোর রাতে খোয়াই বড় লুঙ্গার ঘটনা আজও ভুলে যায়নি ধ্রুপদী ভাষার অধিকারী বাঙালিরা।
সেই চা বাগিচার ম্যানেজার যোগব্রত চক্রবর্তীর লাশ নাকি আজও পায়নি তার পরিবার। ৩৫ লক্ষ টাকার মুক্তিপণ প্রদানের পরও তার দেহ ফিরিয়ে দেয়নি উগ্রপন্থীরা, এমনটাই কথিত। তাকে নাকি টিউব লাইটের কাঁচের গুঁড়ো খাইয়ে অতি কষ্ট দিয়ে হত্যা করা হয়েছিল বলে লোক মুখে প্রচলিত, যদিও সরকারি কোন তথ্য নেই। শুধু যোগব্রত বাবুই নন, মুক্তিপণ মিটিয়ে দিয়ে ফিরে আসা বহু মানুষের মুখেই এমন কথা শোনা গিয়েছিল তখন।
কথিত আছে যে যারাই ফিরে এসেছেন বরাত জোড়ে তারা কখনোই পুলিশি তদন্তের সম্মুখীন হতে চাইতেন না। কেননা একদিকে উগ্রবাদীদের হুমকি অপরদিকে তদন্তের নামে দিনের পর দিন পুলিশি হয়রানি। বাঙালিরা বাঁচতে চেয়েছিল শান্তিতে, কিন্ত এক শ্রেণীর মানুষ তাদের উপর অমানবিক নির্মম অত্যাচার সহ নর সংহার চালিয়েছে। অত্যাচার উৎপীড়ন সহ্য করতে করতে যখন পীঠ গিয়ে ঠেকল দেওয়ালে, শুরু হল বাঙালি বাঁচাও পালা, বদলা নেবার পালা। অল ত্রিপুরা বেঙ্গল ফোর্স (এটিবিএফ) নামক একটি বাঙালি পলিচালিত উগ্রপন্থী দলের সূচনা ঘটে। অনির্ভর সূত্রের খবর যে তৎকালীন এক রাজনৈতিক দলের পৃষ্ঠপোষকতায় ওই এটিবিএফ দলটি ঊনকোটি জেলার কুমারঘাটের একটি গ্রামে (নাম অপ্রকাশিত) অঙ্কুরিত হলেও তা সহজেই দমিয়ে দেওয়া হয়। উল্লেখিত ওই কয়েকটি ঘটনা নমুনা মাত্র, অপহরণ মুক্তিপণ আদায় সহ নর সংহার, আরক্ষা কর্মীদের উপর হামলা সহ অস্ত্র লুঠের ইতিহাস লিখতে লিখতে হয়তোবা কাগজ ফুরোবে, কিন্তু চোখের জলের ব্যথিত ভাষা ফুরিয়ে যাবার নয়।
শুধু বাঙালিরা নয়, রাজ্যের ১৯টি জনজাতি অংশের নিরীহ মানুষ জন সহ মণিপুরী মুসলিম খ্রীষ্টান সব অংশের মানুষ ওই উগ্রবাদীদের হাতে খুন হয়েছে। তৎকালীন উত্তর ত্রিপুরা জেলার অন্তর্ভুক্ত অধুনা ধলাই জেলার দেবীছড়া গ্রামের বর্তমান পিচ করা রাস্তাটি সেকেলে ইট সলিংয়ের ছিল। এই দেবীছড়া গ্রামের উপর দিয়ে ওই হায়নাদের অবাধ চলাচল ছিল পূর্বদিকে ভূমিহীন কলোনী পেড়িয়ে লংতরাই পাহাড় সহ সাইকা পাহাড়। পশ্চিমে লংতরাই হয়ে বড়মুড়া। ওই দেবীছড়া গ্রামের এক স্থানীয় বাসিন্দা কে বা কারা বলে রাতে টর্চ লাইট মারেন তাদের দিকে। ব্যস এক গুলিতে পেটের ভুরুল বেড়িয়ে যায় ওই ব্যক্তির, পরে মর্মান্তিক মৃত্যু। প্রকাশ্য দিবালোকে আর্মীর পরিধানে সজ্জিত কমলপুর ইউবিআই (UBI) ব্যাংক লুঠের ঘটনা দেশবাসির মনে আছে। কজন ধরা পড়ল কজনের শাস্তি হল, ওই লুঠ করা অর্থের কি হল সবই তো আজও ধোঁয়াশার চাদরে মুড়িয়ে রাখা হল। আততায়ীদের বুলেটে নির্মমভাবে খুন হওয়া বাম মন্ত্রী প্রয়াত বিমল সিংহ হত্যাকান্ড, রাজধানীতে মহকুমা শাসক হত্যাকান্ড, বিধায়ক ভোলা সাহা খুন, বিজেপি প্রার্থী শ্যাম হরি শর্মা খুন, সবই জানা আছে রাজ্যবাসির। ৮০ সনের মান্দাই গণ হত্যা রাজ্যের বুকে একটি কাঁটা হিসেবে বিঁধে থাকলেও সময়ের মলমে সব ঘা যেন শুকিয়ে গেছে।
ইদানিংকালের জাতিগত হিংসার রেষ জিরানীয়া থেকে শুরু হয় আছড়ে পড়ল উত্তর জেলার কদমতলায়। ধ্বংশ, হত্যা, ভাঙচুর সবই তো চাক্ষুষ করল জনমানস। কাট অফ করে রাখা হল মোবাইল নেট পরিষেবা। এরই রেষ যেন পা বাড়াল ঊনকোটির দিকে। তড়িঘড়ি করে নেট পরিষেবা তুলে নেওয়া হল। এরপরও কোনপ্রকার ঝুঁকি নিতে চাননি মহকুমা শাসক প্রদীপ সরকার। এসপির সুপারিশে মহকুমা শাসক কৈলাসহর মহকুমায় জারি করলেন 163 BNSS. লোক জমায়েত, অস্ত্র বা লাঠি হাতে চলাফেরা, উস্কানিমূলক পোষ্ট সবকিছুতেই বিধি নিষেধ আরোপ করলেন মহকুমা শাসক প্রদীপ বাবু। যেই দক্ষতা ও বুদ্ধিমত্তার সহিত পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে তিনি সক্ষম হলেন তা প্রশংসার দাবি রাখে। ফলে নিজ ছন্দে ফিরল প্রত্ন শহর বলে খ্যাত কৈলাসহর। কোনপ্রকার হিংসা বিভেদ ব্যতীত আপামর জনতা পুনরায় ফিরেছে তাদের দৈনন্দিন জীবন শৈলী ধারনে। দূরদর্শী ও দক্ষ মহকুমা শাসক প্রদীপ সরকারকে অকুন্ঠ চিত্তে কুর্নিশ জানাচ্ছেন কৈলাসহর সহ ঊনকোটি জেলাবাসি। আপনাকে মনে রাখবে প্রত্ন শহর।।
Comments
Post a Comment